কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম : বিয়ের সময় দুই পরিবারের সম্মতিতে বৈধভাবে বরপক্ষ থেকে যে আর্থিক লেনদেন কনেকে দেওয়ার জন্য নির্ধারিত করা হয়, সেটাই দেনমোহর।
দেনমোহর তা হতে পারে কিছু টাকা বা কোন সম্পত্তি, যা একজন স্ত্রী তার সম্মানের প্রতীক হিসেবে পাওয়ার অধিকার রাখে স্বামীর কাছ থেকে। সেই দেনমোহর একসাথে পরিশোধ করতে না পারলে কিভাবে কিস্তিতে তা পরিশোধ করা যায়, তা নিয়েই আলোচনা করবো এই পোস্টে।
আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনি জেনে নিতে পারবেন, কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম, দেনমোহর মামলার শাস্তি কি হতে পারে, কখন আপনি অর্ধেক দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন এবং আরো রয়েছে দেনমোহর নিয়ে অন্যান্য কিছু বিষয়।
এই পুরো পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে খুব সহজেই জেনে নিতে পারবেন দেনমোহর সংক্রান্ত সকল বিষয় ও তথ্য। তো আসুন প্রথমেই আমরা জেনে নেই, কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম।
{tocify} $title={Table of Contents}
কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম
কিস্তিতে দেনমোহর পরিশোধের নিয়ম হচ্ছে, ইসলামের রীতি অনুযায়ী স্বামী স্ত্রী উভয়ের পরিবার মিলে একত্রিত হয়ে, স্বামীর আর্থিক অবস্থা বুঝে একটা ভালো মানের দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিত। যা নির্ধারণ করলে স্বামী খুব সহজেই বিয়ের সময়ই তা পরিশোধ করে দিতে পারবে। বিয়ের সাথে সাথেই দেনমোহর পরিশোধ করা উত্তম।
দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর হক, তাই এই দেনমোহর প্রদান করা স্বামীর উপর ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "তোমরা খুশি মনে তোমাদের স্ত্রীদের দেনমোহর পরিশোধ করে দাও, অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহরের কিছু অংশ ছেড়ে দিতে পারে", (সূরা-নিসা,আয়াত-৪)। বিয়ের সময় একসাথে যদি পুরোটা পরিশোধ করতে না পারেন তাহলে দুই পরিবারের সম্মতিতে সময় নিয়ে কিস্তিতেও তা পরিশোধ করতে পারবেন। তাও পরিশোধ করতে হবে, দেনমোহর পরিশোধ করাটা বাধ্যতামূলক।
আরো পড়ুনঃ ইসলামী ব্যাংক সরকারি চাকরিজীবীদের লোন
দেনমোহর মামলার শাস্তি
দেনমোহরে রয়েছে স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার, তফসীল -১, অনুচ্ছেদের-১০৩, বিলম্বিত তামাদী আইন অনুযায়ী দেনমোহর আদায়ের সময় সীমা হইলো তালাকের পরে অথবা মৃত্যু হলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিলে ওই তারিখ হতে তিন বছর। দেনমোহর আদায়ের দাবিতে মামলা দায়ের করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে স্ত্রীর।
(ads)
দেনমোহর মামলার শাস্তি হিসেবে ২০০ টাকা থেকে হাজারের উপরেও জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে। ইসলামিক শরীয়ত মোতাবেক এবং দেশের আইন অনুযায়ী বিয়ের সময়ই দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া উচিত। দেনমোহরের অধিকার স্ত্রীদের মুসলিম আইনের উৎস পবিত্র কুরআন দ্বারা স্বীকৃত।
দেনমোহর মামলার রায়
দেনমোহর মামলার রায় হচ্ছে, স্বামীর পাশাপাশি তার পক্ষের যে কেউ, যেমন মা, বাবা, ভাই বা অন্য কোন আত্মীয় দেনমোহর পরিশোধের দায়িত্ব নিতে পারবেন। তাছাড়াও পারিবারিক আদালতে মামলা করে স্বামীর জমি মোহরানা হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে পারবেন স্ত্রী বা স্ত্রীপক্ষের কেউ।
এবং দেনমোহর মামলার রায়ে আরো বলা হয়েছে, জমি যদি না থাকে তবে মুসলিম আইনের অধীনে নগদ, অন্য কোন বৈধ সম্পত্তি বা মূল্যবান জিনিসপত্রও দেনমোহর হিসেবে স্ত্রী নিতে পারবেন, দেনমোহর মামলার রায়ে একথা উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং এ রায়ের ফলে স্বামীর অবর্তমানে (মারা গেলে) যদি দেনমোহর না দিয়ে থাকেন তবে স্ত্রী তার দেনমোহরের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না। মুসলিম বিয়েতে এটি যুগান্তকারী একটি রায় হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আরো পড়ুনঃ ইসলামে চুল কাটার নিয়ম
দেনমোহর কখন অর্ধেক হবে
একজন নারী পুরুষের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পর, যদি শারীরিক মিলন না হয়। অথবা শারীরিক মিলনের পূর্বে স্বামী মারা যান ও যেকোনো কারণ বশত কেউ কাউকে স্পর্শ না করেন, শুধু তবেই বিয়ের সময় দেনমোহর নির্ধারণের অর্ধেক দেনমোহর পরিশোধ করতে পারবেন। অন্যথায়, যদি একবারও সহবাস হয়ে থাকে তাহলে নির্ধারিত দেনমোহরের পরিপূর্ণ ভাগই পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশে সর্বনিম্ন কত টাকা দেনমোহর
ইসলামের শরীয়ত মতে, যেকোনো নারীকে বিয়ে করলে ইসলামী বিধান অনুযায়ী তার প্রাপ্য দেনমোহর নির্ধারণ করে তা পরিশোধ করতে হবে। আল্লাহতালা কুরআনে বলেছেন, "মুমিন সচ্চরিত্রা নারী ও তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা নারীদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো, যদি তোমরা তাদের দেনমোহর প্রদান কর বিয়ের জন্য। প্রকাশ্য ব্যভিচারী গ্রহণকারী হিসেবে নয়" (সূরা-মায়েদা,আয়াত-৫)।
(ads)
তবে আমাদের এখনকার সমাজে কুসংস্কারে ভরে গেছে, সবার মধ্যে লোক দেখানো বিয়ের মাত্রাটা বেড়ে গেছে। জাঁকজমকপূর্ণ, গান বাজনা, অধিক মাত্রায় দেনমোহর নির্ধারণ করা ইত্যাদি। যা ইসলামিক বিরোধিতা সম্পন্ন কাজ, মোটেও উচিত কাজ নয়। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "বিত্তবান নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যয় করবে এবং যার জীবন জীবিকা সীমিত সে আল্লাহ তাকে যা দান করেছেন তা থেকে ব্যয় করবে"(সূরা-তালাক,আয়াত-৭)।
লোক দেখিয়ে অধিক মাত্রায় দেনমোহর নির্ধারণ করে পরে স্ত্রীর কাছে গিয়ে মাফ চাওয়া এটা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। স্বামীর সামর্থের উপর দেনমোহর নির্ধারণ করা উচিত যা সে বিয়ের সময়ই পরিশোধ করে দিতে পারবে। বিয়ের সময় দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। সর্বনিম্ন দেনমোহর হবে ১০ দিরহাম ( পৌনে তিন ভরি রুপার মূল্য যখন যা আসবে তাই পরিমাণ সর্বনিম্ন দেনমোহর)।
আরো পড়ুনঃ কালোজিরা খাওয়ার নিয়ম ও উপকারিতা
দেনমোহর কখন আদায় করতে হয়
ইসলামিক রীতিতে বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন এবং এই পবিত্র বন্ধন এর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ দেনমোহর। যা পরিপূর্ণভাবে একজন স্ত্রীর প্রাপ্য তার স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া দেনমোহর। শরীয়ত মোতাবেক দেনমোহর দুইভাবে আদায় করা যায় নগদ দেনমোহর ও বাকী দেনমোহর। স্বামীর কাছে যদি উপস্থিত সময়ে দেনমোহর পরিশোধ করার মতো কোনো সম্পদ না থাকে, সেই দেনমোহর পরে আস্তে আস্তে দিলেও হবে তবে এখানে স্ত্রীর বা তার পরিবারের সম্মতি থাকতে হবে।
তাছাড়া যদি স্বামীর আর্থিক অবস্থার উপর বিবেচনা করে নগর দেনমোহর দেওয়ার শর্ত করা হয়, তবে দেনমোহর বিয়ের সময়ই পরিশোধ করে দেওয়া উত্তম। দেনমোহর পরিশোধ না করে যদি স্বামী মারা যান তবে তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায়, আইনানুক ব্যবস্থা নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে স্ত্রীর।
দেনমোহর পরিশোধ না করার শাস্তি
বিয়ের সময় দেনমোহর পরিশোধ করা উত্তম, তবে কোন কারণে পুরোপুরি পরিশোধ করতে না পারলে, বর ও কনে দুই পরিবারের সম্মতিতে সময় নিয়ে বিয়ের পরে তা পরিশোধ করে দেওয়া উচিত। স্বামী দেনমোহর আদায় না করলে তা ঋণ হিসেবে আজীবন থেকে যাবে এবং স্ত্রী যদি এই দেনমোহর মাফ না করেন, তবে কিয়ামতের ময়দানে সেই স্বামী অপরাধী সাব্যস্ত হবেন। তাই অবশ্যই স্ত্রীর দেনমোহর পরিশোধ করে দেওয়া খুবই জরুরী।
(ads)
তারপরও দেনমোহর পরিশোধ করার নিয়তে দেনমোহর বাকি রেখে বিয়ে করাও বৈধ আছে, কিন্তু অবশ্যই বাধ্যতামূলক পরে তা পরিশোধ করে দিতে হবে। দেনমোহর পরিশোধ না করলে একজন পাওনাদারের কাছে যেরকম ঋণী থাকবেন ঠিক তেমনি আপনি আপনার স্ত্রীর কাছেও সারা জীবন ঋণী থাকবেন এবং পরকালে অবশ্যই দোষী সাব্যস্ত হবেন। তবে স্ত্রী যদি তার নিজ সম্মতিতে খুশি মনে কিছু অংশ দেনমোহর ছেড়ে দেন, তবে তা স্বামী হালাল ভাবে স্বাচ্ছন্দে ভোগ করতে পারবেন।
সর্বশেষ
দুইজন নর-নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে বিয়ের বন্ধনের মাধ্যমে। সেই বন্ধনকে আরও অটুট রাখতে দেওয়া হয় স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীকে তার সম্মানে সম্মানিত করে তার প্রাপ্য দেনমোহর। যা একটি বিয়েতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বিশেষ। সঠিক সময়ে দেনমোহর পরিশোধ করা উত্তম এবং কুরআনে বলা হয়েছে " স্ত্রীর দেনমোহর ফাঁকি দেওয়া অতি হীন কাজ, যে এ কাজ করে তাকে বলা হয় ব্যভিচারী"।
সেই গুরুত্বপূর্ণ দেনমোহর সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও কার্যকলাপ নিয়েই আমাদের আজকের এই পোস্টটি সাজানো হয়েছে পুরো পোস্টটি পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। অবশ্যই দেনমোহর নিয়ে আপনাদের কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন, আমরা সর্বদাই আপনাদের পাশে আছি। জাযাকাল্লাহ খাইরান।